ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

সবুজ অরণ্য। চট্টগ্রাম অফিস

সময়টা তখন বিদায়ী বর্ষার। প্রকৃতিতে শরৎ কে বরণ করার মাতোয়ারা ঘ্রাণ। কখনো রোদ্দুরের ঝিলিক, কখনো আবার আকাশের মুখভারি আলাপন। শহরতলী বোয়ালখালীর কোল ঘেঁষে বয়ে চলা কর্ণফুলী কখনো কখনো উজানের জলে পূর্ণ হয়ে রূপ ধারণ করে চঞ্চলা কিশোরীর। অনতিদূরে সাঙ্গু- হালদা আর কর্ণফুলীর ত্রিবেণী তট। পত্র পল্লবীর ছায়াঘেরা মেঠোপথ পারি দিয়ে সামনে এগুলেই চোখে পরে শান্ত সুনিবিড় এক জনপদ। প্রশাসনিক কাঠামোর খাতিরে গ্রামের নামাঙ্কিত হয় পশ্চিম কধুরখীল।

১ জুন ১৯৪৮ গ্রামীণ আবহে মা-বাবার কোল জুড়ে আসে এক ভূমিপুত্র। বাড়ির মুরব্বিরা আদর করে নাম রাখেন মোছলেম উদ্দিন। পরবর্তী সময়ে যিনি হয়ে উঠেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির বরপুত্র। মোসলেন উদ্দিন শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন। তিনি ছিলেন অনন্য এক সৃজনশীল প্রতিভার অধীকারী ব্যক্তি। ছাত্রজীবন থেকে যুক্ত ছিলেন সাহিত্য চর্চ্চার সাথে।

উনসত্তরের উত্তাল সময় পেড়িয়ে দেশ যখন পা রাখলো সত্তরের উঠোনে তখনই এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসে তরুণ মোছলেম উদ্দিন। তাঁর সম্পাদনায় প্রাকাশ করেন “জয় বাংলা”
নামে একটি সাময়িকী। সেই থেকে শুরু, পরবর্তীতে নিজের সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে “সাপ্তাহিক সাহসী ঠিকানা” নামে একটি
প্রকাশনা। সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও অমিত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি।

তরুণ মোছলেম উদ্দিন
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্নক অসহযোগ আন্দোলন ও ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ছাত্রনেতা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন তিনি।

চট্টগ্রাম স্টেশন রোড সংলগ্ন রেস্ট হাউজে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাঙালি ইপি আর, বাঙালি আনসার, বাঙালি পুলিশ, বাঙালি সেনাবাহিনীর সদস্যরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল সে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে অস্ত্র, পরিধেয় কাপড় ও খাদ্য সামগ্রী
সংগ্রহের কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

সমগ্র চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ এলাকা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। বাঙালিরা দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র, লাঠি, বল্লম, তীর ধনুক এমন কি মরিচের গুড়া নিয়ে বাঙালি মহিলারা নিজ এলাকার রাস্তায়, বাসার ছাদে, দালানের কোণায় অবস্থান করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য অসীম মনোবল ও সাহস নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি কমান্ডোদের অতর্কিত আক্রমণে সেদিন জামালখান চেরাগী পাহাড় মোড়ে শহীদ হন দীপক, জাফর ও বদরুজ্জামানের মত বীর মুক্তিযোদ্ধারা, আর এমনি এক কমান্ডো বাহিনীর হাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে গ্রেপ্তার হন ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমদ ও মোহাম্মদ ইউনুস। দীর্ঘ আড়াইমাস তাঁরা চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী ছিলেন।

কারাগারে বন্দী থাকাকালেই তাঁদের মাথায় এলো এক দুঃসাহসিক চিন্তা। কীভাবে কারাগার থেকে পালানো যায়। যেভাবে, সে কাজ; তাঁরা পাগল সেজে কারাগার থেকে বের হয়ে গেলেন। কারাগার থেকে পালানোর পর আবারো জড়িয়ে পড়েন দেশকে শত্রু মুক্ত করার যুদ্ধে। যাদের মধ্যে মোছলেম উদ্দিন ছিলেন অন্যতম।

মোছলেম উদ্দিন ছিলেন একজন সার্বক্ষনিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে তিনি ওই কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম শহর শাখা (বর্তমান মহানগর) ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮২ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এছাড়া আওয়ামী যুবলীগ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

পরবর্তীতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন, এবং
২০০৫ সালের ২৩ জুলাই সম্মেলনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে মোছলেম উদ্দিন আহমদকে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয়। সে-ই থেকে আমৃত্যু সভাপতি হিসেবে ছিলেন নেতা-কর্মীদের মাথার উপর বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে।

২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারী চট্টগ্রাম-৮ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মঈনউদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে শুন্য আসনের উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সম্পাদক এই মানুষটি ১৯৭১ এর রণাঙ্গনে সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের জন্য লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনে দিলেও হেরে যান মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে। দীর্ঘ সময় ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মাত্র ৭৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উজ্জ্বল নক্ষত্র।

তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারালাম আমাদের অভিভাবককে, জাতি হারালো তাদের সূর্য সন্তান। দেখতে দেখতে পেড়িয়ে গেল এই উজ্জ্বল নক্ষত্র পতনের একটি বছর। আজ তারঁ প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে এই মহান বীরের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »