সারাদেশের সকল সংবাদমাধ্যম যখন কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সদ্য বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ বাবুকে নিয়ে খবর প্রকাশ করছে, সে সময় আমি লিখছি চুমকি দাসকে নিয়ে। চুমকি দাস, মানে প্রদীপ বাবুর সুযোগ্যা স্ত্রী, প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক যার ৪৫ ভরি গয়না রয়েছে, দামি প্রসাধনী আর আসবাব রয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্ল্যাট রয়েছে, রয়েছে কেনা ও দখল করা জমি, রয়েছে কারি-কারি অবৈধ টাকা।
এটা ধ’রেই নেওয়া যায়, টাকা দিয়ে চুমকি দাস এবং প্রদীপবাবু সুখ কিনতে চেয়েছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত কী বর্ণিল জীবন যাপন করেছেন চুমকি দাস, তা সহজেই অনুমেয়। টাকা,গয়না, প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার দাপটে চুমকি দাস ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। এই চুমকি দাস রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় অনেকেই হয়তো রাস্তা ছেড়ে দিয়েছেন। এটা প্রমাণিত সত্য, চুমকি দাসদের ভয়ে শুধু মহল্লার লোকজন নয়, স্বয়ং প্রদীপবাবুরাও তটস্থ থাকেন। আর কোনো বিষয়ে জ্ঞান থাক বা নাই থাক, চুমকি দাসরা একটা বিষয় খুব ভালো জানেন।
তারা জানেন, জীবনে কেবল টাকা টাকা আর টাকা দরকার। এই কারণে প্রদীপ বাবুরা যখন অবৈধ পথে উপার্জন করা বস্তা-বস্তা টাকা নিয়ে বাসায় ফেরেন, তখন আনন্দে চুমকি দাসদের চোখ জ্বলজ্বল করে। পাপের টাকা অনেক বেশি সু-স্বাদু হয়। একবার এই স্বাদ গ্রহণ ক’রে ফেললে মানুষ আর পেছনে ফিরতে পারে না। ফিরতে পারেননি চুমকি দাসও। আর ফিরতে পারেননি বলেই দেশে-বিদেশে এতো সম্পদ গড়েছেন, দিনের পর দিন প্রদীপবাবুকে উৎসাহ দিয়েছেন সকল অপকর্মে। লোভের লাগাম টানতে না পারলে যা ঘটে, অবশেষে তাই ঘটেছে চুমকির জীবনে।
প্রদীপ বাবু এখন কারাগারে, ঘাড়ে তার খুনের মামলা। নিজের সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, দেশবাসী, এমনকি বহির্বিশ্ব জানলো, প্রদীপবাবু একজন মাদক মাদক ব্যবসায়ী, প্রদীপ বাবু একজন চোর, প্রদীপ বাবু একজন মাস্তান, প্রদীপ বাবু একজন অসৎ মানুষ, প্রদীপ বাবু একজন খুনি, প্রদীপ বাবু বাংলাদেশের গর্বিত পুলিশ বাহিনীর একজন নষ্ট সদস্য। প্রদীপ বাবুর পরবর্তী প্রজন্ম যতোদিন বেঁচে থাকবেন, বংশপরম্পরায় তারা এই কলঙ্ক বয়ে বেড়াবেন। তারা কারো কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না। তারা সারা জীবন লজ্জায় মাথা নত করে থাকবেন। প্রতিদিন তারা ছোটো হয়ে যাবেন।
প্রতি পলকে তাদের মরে যেতে ইচ্ছে করবে। সারারজীবন মানুষ তাদের মুখে থুথু ছিটাবে। এই যে এতো-এতো নেতিবাচক অর্জন, তার মূল কারণ কিন্তু একটাই। সেই কারণের নাম হচ্ছে লোভ। লোভ মানুষকে নিকৃষ্ট পশুর চাইতে নিচে নামিয়ে ফেলে। ছোট্ট একটা থাকার ঘর, আকাশ দেখার মতো একটা জানলা, মোটা চালের একটু ভাত, একটু শাক, একটু আলু ভর্তা আর পুঁটিমাছের একটু ঝোল, এইটুকু নিয়েই তো সুখে আছে লাখো-লাখো মানুষ। জীবনে কতো টাকা লাগে সুখী হতে? ছোট্ট একটা জীবনে কেবল টাকা উপার্জন করার চাইতেও তো অনেক মহৎ কাজ থাকে। মানুষের বই পড়া দরকার, মানুষের গান শোনা দরকার, মানুষের মানুষের পাশে দাঁড়ানো দরকার, রাষ্ট্রের কল্যাণে মানুষের নিবেদিত হওয়া দরকার।
এসব দায়িত্ব ভুলে গিয়ে মানুষ যখন কেবল টাকার পেছনে ছোটে, তখন সে আর মানুষ থাকে না। মিথ্যে মাদক মামলার নাটক সাজিয়ে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে যখন তুলে আনতো প্রদীপ বাবু, আবার যখন টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ছেড়ে দিতো, সেসব মানুষ এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মানসিক অবস্থা তখন কেমন হতো, চুমকি দাস হয়তো কোনদিন তা ভেবে দেখেননি। যারা সাজানো ক্রসফায়ারে মরেছে, তাদের কতো-কতো অভিশাপ বাতাসে-বাতাসে ছড়িয়ে গেছে, কতো করুন আর্তনাদে সভ্যতা নুয়ে পড়েছে বারংবার, সেসব চুমকি দাস মনে রাখেননি।
প্রদীপ বাবু কারাগারে যাওয়ার পর হয়তো তিনি হিসেবের খাতা খুলে বসেছেন। এখন তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন, প্রিয়জন হারিয়ে গেলে কেমন লাগে। জগতে যতো প্রদীপ বাবু নষ্ট হয়েছে, চুমকি দাসরা ছিলো তার নেপথ্য কারণ। চুমকি দাসদের দশটা বায়না মেটাতে গিয়ে প্রদীপ বাবুদেরকে বাঁকা পথে হাঁটতে হয়। নিজের বিবেক বুদ্ধির মাথা খেয়ে, সভ্যতা সততা আর শালীনতাকে পাশ কাটিয়ে প্রবেশ করতে হয় অন্ধকার জগতে। ওই মায়ার জগতে প্রবেশ ক’রে প্রদীপ বাবুরা এতোটাই ভেতরে ঢুকে যান যে, একসময় চাইলেও আর ফিরে আসতে পারেন না।
একথা সবাই স্বীকার করে, জীবনের জন্য টাকা দরকার। পাশাপাশি এটাও স্বীকার ক’রে নিতে হবে, কেবলমাত্র টাকার জন্যই জীবন নয়। জীবনের অনেক মহৎ উদ্দেশ্য আছে। সেইসব মহৎ উদ্দেশ্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করতে হয়। যে জীবন মানুষ এবং মানবতার কোন কাজে আসে না, সে জীবন কীটপতঙ্গের জীবনের চাইতেও নিকৃষ্ট। লোভের লাগাম টেনে জগতের সকল চুমকি দাসরা ভালো থাকুক, আর ভাল রাখুক প্রদীপ বাবুদেরকে। পরিশেষে কথা তো একটাই- মানুষ বাঁচে ক’দিন???
