ক্যামেলিয়া নিশান:
ওয়েব সিরিজ শব্দটির সাথে আমাদের দেশের সাধারন জনগন এখনও তেমনভাবে পরিচিত নয়। টেলিফিল্ম, নাটক, ধারাবাহিকই আমরা মোটামুটি বুঝি। প্রথম দিকে যখন বাইরের দেশের ওয়েব সিরিজ দেখা শুরু করলাম, তখন ভেবেছিলাম শর্টফিল্ম টাইপ কিছু হবে। তারপরেই পুরো ব্যাপারটি পরিস্কার হলো। বিনোদন বলতে আমরা যা কিছু বুঝি ঠিক তেমনই, জাস্ট খন্ড নাটকের মতোই। প্রথমে বাইরের দেশেরটা দেখলেও বাংলাদেশের কিছু ওয়েব সিরিজও দেখা শুরু করলাম।
ভিনদেশী কিছু দেখার পাশাপাশি কলকাতার ওয়েব সিরিজ তো আমি একটাও বাচ্চাদের নিয়ে দেখতে পারলাম না। আমাদের চোখ থাকে অন্য দেশের দিকে, নিজেদের সব বিসর্জন দিয়ে অন্য দেশের সংস্কৃতি ধার করে আনি। ওদের জন্য যা জায়েজ, আমাদের জন্য তা নয় – এটা আমরা বার বারই ভুলে যাই। ওরা প্রকাশ্য যত্রতত্র প্রিয়জনকে হাগ করে, কিস করে। আর আমরা এর ঠিক পুরো উল্টোটা। আমাদের দেশের ওয়েব সিরিজ শেষ দেখলাম “১৪ আগস্ট”। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে এই ওয়েব সিরিজে অনেক রগরগে সিন ছিল, যা বাচ্চাদের নিয়ে দেখতে বসেই আমি বিব্রত বোধ করি। আমাকে বার Skip করতে হয়।
এখানে গল্পের নায়িকা টুশি যখন বাসা খালি পেয়ে রাস্তার পাশের তরুন যুবক বিড়ি সিগারেট ওয়ালাকে চোখের ইশারায় ডাকে, তখন আমার ১১ বছরের ছেলে – বলে “মাম্মি” মেয়েটা কেনো ওই ছেলেকে ডেকে আনছে বাসায়। খালি বাসায় তো ছেলেটা ওকে মেরে ফেলবে। আমি আমার বাচ্চাদের এভাবেই বুঝিয়ে ঘর থেকে বের হই, যখন আমি একা কাজে কোথাও বের হই। অশ্লীলতার অভিযোগ করা আরও দুটি ওয়েব সিরিজের দিকেও চোখ রাখলাম।
“বুমেরাং” এবং “সদরঘাটের টাইগার”। অশ্লীল দৃশ্য এবং এবং অশ্লীল সংলাপে ভরপুর। এই যদি হয় ওয়েব সিরিজের অবস্থা, তাহলে দরকার নাই আমার পয়সা দিয়ে এই সমস্ত অশ্লীলতা দেখার। কারন, আমরা নাটকে, ধারাবাহিকে এই এগুলো দেখে অভ্যস্ত নই। আমরা মেহেজাবিনের কান্না, তানজিন তিশার রোমান্টিকতা, আফরান নিশোর মাস্তানি, অপূর্ব ‘র মধ্যবিত্ত মার্কা “বড় ছেলেকেই” বার বার দেখতে চাই। এই তিনটি ওয়েব সিরিজের সেই ক্লিপগুলো এখন ইউটিউব এবং ফেসবুক নিউজ ফিডগুলোতে ঘুরছে।
আমি জানি আমার বাচ্চাদের চোখে বা এমন হাজারও বাচ্চাদের চোখে এগুলো পড়ছে, এবং পড়বেই। এবং এই তিনটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা বিভিন্ন চ্যানেলে। লাইভে এনে তাদের এবং আরও অনেক গুণী নির্মাতা, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের প্রশ্ন এবং এই বিষয়ে মতামত জানতে চাইছেন । এই ওয়েব সিরিজগুলো দেখে আমাদের দেশের নাট্যপ্রেমীরা অনেক কঠিন ভাবেই রিএ্যাক্ট করেছেন।
ইতিমধ্যে এটি মন্ত্রী মহাদয়, আইনজীবী পর্যন্ত গড়িয়েছে। অনেক সুধীজনের ধারনা এটি একটি Selective content, এটি নিজের পরিবারকে না নিয়েও ইচ্ছে মতো একাও দেখা যায়। সেটা তো ঠিক, কিন্তু সেটা তো আমরা নিষিদ্ধ যা কিছু তাও একাই দেখতে পারি। তবে সেই নিষিদ্ধ, অশ্লীল কিছু আমরা আমাদের দেশের নির্মাতা, এবং অভিনেতা – অভিনেত্রীর কাছ থেকে একেবারেই আশা করি না। তার কারন, এদের আমরা এতোদিন যে যায়গাটাতে দেখেছি, এখন তার থেকে আলাদাভাবে একেবারেই মেনে নিতে পারছি না। ওদের দেখেই বড় হচ্ছে আমাদের আজকের প্রজন্ম।
আমাদের বাচ্চাদের আমরা এটা বলেই সব সময় বুঝিয়ে এসেছি যে, এসব আমাদের দেশের সংস্কৃতি, ধর্ম সামাজিকতা কোন কিছুর সাথেই যায়না। আমরা সব সময় এই সব কার্যকলাপ ভিনদেশীদের দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর তাই এই সমস্ত ওয়েব সিরিজের নামে অশালীন কোনো কিছুই আমরা চাই না। ওয়েব সিরিজ চাই, তা হবে সুস্থ সুন্দর। পরিবারকে নিয়ে দেখা যাবে। আবার একা বসেও দেখা যাবে এমনটা। আমাদের মরহুম হুমায়ুন আহমেদ স্যারের নাটক সিনেমা কি আমরা দেশের মানুষ দেখিনি। আবাল, বৃদ্ধ বনিতা…? কে পছন্দ করেনি ..? আমি পুরো লকডাউনে আমার বাচ্চাদের নিয়ে দেখেছি সেগুলো। অনেক উপভোগ করেছি। সেই সব নাটক সিনেমায় কি আমরা অশ্লীল কিছু পেয়েছি…?
অশ্লীলতা নয়, ভালো গল্প, সুনিপুণ নির্মান, অভিনয় শৈলী দেখিয়ে আমাদের টিভিমুখী করুন। নেটফ্লেক্স, এমাজন প্রাইম, হইচই, জি ফাইভ – এখান থেকে শেখার মতো কী দিচ্ছে আমাদের প্রজন্মকে ? আমাদের সমাজকে ? আমরাও অপেক্ষায় রইলাম ভাল কিছুর, যেটা থেকে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির জন্যে সুফল আসবে। কুফল নয়।

লেখক : দেশীয় চলচ্চিত্রের সাবেক নায়িকা