রাজ্যের হতাশা বুকে চেপে উঁকি দিয়েছে ঈদের চাঁদ। এমন নির্বাক- নিস্তব্ধ ঈদ এর আগে আর দেখেনি বাংলাদেশ। পথে-ঘাটে কোনো হট্টগোল নেই, ফাঁকা পড়ে আছে অধিকাংশ বিপণিবিতান, বাসস্ট্যান্ড কিংবা রেলস্টেশনে ঘরছাড়া মানুষের দীর্ঘ সারি এখন কেবলই স্মৃতি। দুর্দান্ত প্রতাপে করোনা যখন চালাচ্ছে তার ধ্বংসযজ্ঞ, ঠিক সেই সময় আবার হানা দিয়েছে ভয়ঙ্কর বন্যা। একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
শহরের ভাসমান মানুষ কিংবা মৌসুমী ছোট্ট ব্যবসায়ীরা চোট সামলাতে না পেরে রাজধানী ছেড়ে গেছেন অনেক আগেই। এবারের ঈদে যারা গ্রামে যাবেন, তাদের অনেকে আর ফিরে আসবেন না সহসা। ফিরে আসবেন না মানে আসতে পারবেন না, মানে ফিরে আসার উপায় নেই। অনেক দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মী ছাঁটাই। একমাত্র সরকারি চাকুরে ছাড়া যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন দিশেহারা।
বড়-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানও চাপের মুখে সীমিত করে ফেলছে তাদের লোকবল। উৎপাদনহীনতায় কোনো প্রতিষ্ঠানই দীর্ঘদিন চলতে পারে না। ঈদকে সামনে রেখে এখন যারা গ্রামে ফিরছেন, ইচ্ছা থাকলেও তাদের অনেকেই আর ফিরতে পারবেন না তাদের প্রিয় রাজধানীতে। প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটা অসহায়, এবার ভালো করেই প্রকৃতি তা দেখিয়ে দিয়েছে।
শহরে যারা ভাড়াটিয়া, তাদের কষ্ট আজীবনের। উপার্জনের সাথে খরচের হিসেব কোনোদিনই তারা মেলাতে পারেননি। ভাড়াটিয়াদের ক্রমাগত অনটন এবার কিন্তু বাড়িওয়ালাদেরও চাপে ফেলে দিয়েছে। বাড়ির আয় দিয়েই যেসব বাড়িওয়ালা জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ করেন, এবার তারাও পড়েছেন মহাবিপাকে। অনেক ভাড়াটিয়া সময়মতো তাদের ভাড়া পরিশোধ করতে পারেননি। অনেক ভাড়াটিয়া না পারছেন ঢাকায় থাকতে, না পারছেন ঢাকা ছাড়তে। এদিকে ভাড়াটিয়ারা ঠিকমতো ভাড়া পরিশোধ না করায় অনেক বাড়িওয়ালার চোখে অন্ধকার।
ভাড়াটিয়াদের বের ক’রে দিলে এখন বাসা ভাড়া হবার আর তেমন সম্ভাবনাও নেই, আবার মাসের পর মাস বাসা ভাড়া না পেয়ে বাড়ি ভাড়া দিয়েই বা লাভ কী? যদিও আমরা বিশ্বাস করি শহরের বেশিরভাগ মানুষ সময়মতো বাড়ি ভাড়া পরিশোধ ক’রে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষকে করেছে আলাদা, রুদ্ধ করেছে প্রগতি আর উৎপাদনশীলতার সকল পথ। তবে এসব কিছুর ভিড়েও একশ্রেণীর মানুষ বেশ ভালো আছে। ভালো আছে তারা, যারা বাঁকা পথে টাকা কামিয়েছে। যেসব মানুষ নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না, যেসব মানুষের মনে মানবতা কিংবা দেশপ্রেম নেই, অর্থনৈতিকভাবে তারা ভালো আছে, তারা ভালো থাকে, তারা ভালো থাকবে।
ধর্মীয় মূল্যবোধ কিংবা পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষায় সারাজীবন যারা ঈদ এলে পশু কুরবানি করেছেন, তাদের অনেকেই এবার কুরবানি দিতে পারছেন না ৷ সঙ্গত কারণেই মনে-মনে তারা খুব কষ্ট পাচ্ছেন। তাই যারা কোরবানি করছেন, তাদের এবার অনেক বেশি মানবিক হতে হবে। সচ্ছল ব্যক্তিদের ছোট্ট একটি আচরণে তার পাশের বন্ধুটির মন ভেঙে যেতে পারে। কেউ কুরবানি করতে পারছেন বলেই তিনি অনেক মহৎ মানুষ, এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এবারের ঈদের আনন্দ সবার সাথে ভাগাভাগি ক’রে প্রমাণ করতে হবে, মানুষ তো মানুষেরই ভাই, মানুষ তো মানুষেরই বন্ধু, মানুষ তো মানুষেরই সহযাত্রী, মানুষ তো মানুষেরই আপনজন।
করোনার ভয়াবহতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমরা। তার উপর অপ্রত্যাশিত বন্যায় বিধ্বস্ত হয়েছে জনজীবন। আমরা এখন স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আমরা জানি না, আবার কবে শান্ত হবে পৃথিবী, আবার কবে ভালো থাকবে পৃথিবীর মানুষ। যারা ঈদে বাড়ি যাচ্ছেন, কিংবা যারা শহরে রয়ে গেছেন, শত কষ্ট হলেও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই পালন করতে হবে। আমরা যেভাবেই ভাবি না কেনো, সবশেষ কথা তো একটাই- জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।

যারা করোনাক্রান্ত, যারা বন্যায় বিধ্বস্ত, যারা অনাহারি, যাদের চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ নেই, আসুন আমরা সবাই তাদের পাশে দাঁড়াই, তাদের দুঃখ কষ্টগুলো ভাগ করে নিই সানন্দচিত্তে। একা-একা সুখে থাকা মানুষের কাজ হতে পারে না। মানুষ মানবিক প্রাণী বলেই তারা পশু হতে আলাদা, তারা উচ্চতর। মানবতা আর সহমর্মিতার মূলমন্ত্র রপ্ত ক’রে সমস্বরে এখনই তো ব’লে ওঠার দিন- আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসেনাই কেহ অবনী ‘পরে সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।।
প্লাবন কোরেশী সংস্কৃতিক